শাহজাদা আল হাবীব
প্রায় আট মাস হতে চললো শোনা হয় না শাটল ট্রেনের হুইসেল, ক্লাসের ফাঁকে বসা হয় না ঝুপড়িতে, হয় না ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে প্রাণখোলা আড্ডা, গাওয়া হয় না গলা ছেড়ে গান। কে জানতো তখন মহামারি এভাবে নিঃস্তব্ধতার শেকলে বন্দি করবে ২১০০ এককের চিরচেনা এ ক্যাম্পাসকে! এ বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও। বর্তমানে সীমিত পরিসরে চলছে অফিসিয়াল কার্যক্রম। একসময় যে হলগুলো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ও সহাস্যে মুখরিত থাকতো সেগুলো এখন যেন পরিণত রয়েছে ভূতুড়ে বাড়িতে! মানুষের বিচরণ থেমে গেলে বুঝি এমন হয়! পরিচিত জায়গাগুলো যেন প্রাণ হারায়।
পৃথিবীতে একমাত্র ‘চবি’র-ই রয়েছে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নিজস্ব শাটল ট্রেন। শাটল ট্রেন থেকে রেলস্টেশনে নেমে খানিকটা সামনের দিকে এগুলেই চবির জিরো পয়েন্ট। সেখানে দম্ভভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কাটাপাহাড়। এ পাহাড়ের বুকে চিঁরে বেরিয়ে গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অভিমুখী মূল পথ। দুপাশে পাহাড় মাঝে চলে সরলরেখার মতন দীর্ঘ পথ। এটাই ‘কাটাপাহাড় রাস্তা’ নামে পরিচিত। এ পথ ও পাহাড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে জড়িয়ে আছে হাজারো শিক্ষার্থীর আনন্দ বেদনার স্মৃতি। কাটাপাহাড়ে প্রায়ই দেখা মিলে মায়া হরিণ,বুনো শুয়োর ও বনমোরগসহ বিচিত্র প্রজাতির বন্যপ্রাণীর। পথচারীরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির সাপের দেখাও পায়! তবে দুর্ঘটনার ঘটনা নেই বললেই চলে। এখানে রয়েছে মানব ও প্রাণিকূলের সহবস্থান। জিরো পয়েন্ট থেকে হাতের বাম পাশের রাস্তাটি চলে গেছে সাউথ ক্যাম্পাস হয়ে ফরেস্টি ইন্সটিটিউটে এবং হাতের ডান পাশের রাস্তাটি ছেলেদের বেশ কয়েকটি হল, সেন্ট্রাল মসজিদ, আইন অনুষদ হয়ে ক্যাম্পাসের দুই নম্বর গেট।
আইন অনুষদের কাছেই রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মেডিকেল সেন্টার ও আইইআর ডিপার্টমেন্ট। আরেকটু পশ্চিমে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ও অত্যাধুনিক জিমনেসিয়াম। বিশাল আকারের এই খেলার মাঠে প্রতিদিন বিকালে মিলনমেলা হয় শিক্ষার্থীদের। সমানতালে এগিয়ে চলে খেলাধুলা, আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় ও গান। সেখানে সন্ধ্যা নামার ক্ষণ শুরু হলেই উত্তর দিকের উঁচু উঁচু বৃক্ষরাজিগুলো পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। আহা! সে কী এক অপরূপ স্বর্গীয় দৃশ্য। যে কাউকেই বিমোহিত করার জাদুকরী ক্ষমতা রাখে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
জিরো পয়েন্ট থেকে সোজা কাটাপাহাড় রাস্তা ধরে এগুলে হাতের ডান পাশে চোখে পড়বে বিবিএ ফ্যাকাল্টি,একটু সামনে দেখা যাবে শহীদ মিনার চত্বর, জয় বাংলা ভাস্কর্য এবং বুদ্ধিজীবী চত্বর। এ জায়গাগুলোতে আড্ডা ও পাঠচক্র জমে নিয়মিত। শহীদ মিনার চত্বর থেকে বাম পাশের রাস্তাটি লেডিস ঝুপড়ি, মেয়েদের হল, ভিসির বাসভবন ও বঙ্গবন্ধু উদ্যান হয়ে চলে গেছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ডান পাশের রাস্তাটি চলে গেছে সমাজবিজ্ঞান অনুষদ,নির্মাণাধীন দ্বিতীয় কলা অনুষদ হয়ে ছেলেদের রব ও বঙ্গবন্ধু হলের দিকে। আর নাক বরাবর থাকা রাস্তাটি ধরে সামনের দিকে এগুলেই হাতের বাম পাশে চোখে পড়বে উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ, সিএসসি ডিপার্টমেন্ট ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এবং ডান পাশে দেখা যাবে প্রশাসনিক ভবন এবং এখানের সবচেয়ে প্রাচীন ভবন কলা অনুষদ। কলা অনুষদের পরেই রয়েছে কলা ঝুপড়ি। এখানে নিয়মিত গানের আসর বসে এবং জম্পেশ আড্ডা হয়। যারা রাজনীতিতে যুক্ত তাদের রাজনৈতিক সলাপরামর্শও এখানে সংঘটিত হয়ে থাকে। ঝুপড়ির বিপরীত দিকে রয়েছে ‘চাকসু’ ভবন। চাকসু ভবনের সামনের রাস্তাটি চলে গিয়েছে সাইন্স ফ্যাকাল্টির দিকে।
১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জোবড়া গ্রামে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৩ হাজার ৫৫৪ জন শিক্ষার্থী এবং ৯২০ জন শিক্ষক রয়েছেন। আঁকাবাঁকা পাহাড়, চঞ্চলা ঝর্ণা, বিচিত্র বন্য জীবজন্তু ও অগণিত বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ এ ক্যাম্পাসটি দেশের তৃতীয় এবং আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নয়টি অনুষদের অধীনে মোট ৪৮টি বিভাগ এবং ছয়টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। চবিতে বর্তমানে সর্বমোট ১৩টি আবাসিক হল রয়েছে। যার মধ্যে ৮টি ছাত্রহল ও ৫টি ছাত্রীহল। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১টি হোস্টেল রয়েছে। রয়েছে ৩.৫ লক্ষ বই নিয়ে বিশাল আকারের একটি লাইব্রেরি। আছে তিনটি পৃথক জাদুঘর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও খেলার মাঠ।
গত ১৮ নভেম্বর ছিলো চবির চুয়ান্নতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিবছর এ দিবস ক্যাম্পাসকে নানা রঙে বিচিত্র ঢংয়ে সাজিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এবার মহামারির জন্য এসবের কিছুই হয়নি। করোনা ভাইরাসের তোপের কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা সশরীরে ক্যাম্পাসে থেকে দিনটিকে উদযাপন করতে না পারলেও তারা ভার্চুয়ালি বরণ করে নিয়েছে বিশেষ দিনটিকে। কেউ ফেসবুকে বিশেষ প্রোফাইল পিকচার সাঁটিয়ে, কেউ ফেলে আসা পুরনো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজে স্মৃতিকাতর হয়েছেন ও বন্ধুদেরও স্মৃতিকাতর করিয়েছেন।
করোনা ভাইরাস বদলে দিয়েছে পৃথিবীর অনেক হিসাব-নিকাশ। পরিবর্তন এনেছে আমাদের যাপিত জীবনে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া না দেওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল বলছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্য সব কিছুর মতো ক্যাম্পাস খুলে দিতে। অপরদল সেকেন্ড ওয়েভ না দেখে এখনই কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। এদিকে চবির কিছু ডিপার্টমেন্টে আগে থেকেই ছিলো সেশনজট, কিছু ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা মাঝপথে আটকে আছে। আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো নিয়ে নেবার জন্য কিছুদিন আগে শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন করে শিক্ষার্থীরা। তারপর প্রশাসন জানিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া হবে। তবে হল খুলে দেওয়া হবে না। হয়তো প্রশাসন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে হল খোলার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে। ততদিন ভালো থাকুক প্রিয় প্রাঙ্গণ। ক্রমেই আরো মনোহর হয়ে উঠুক। সুন্দর কিছু দেখবো বলেই অপেক্ষা করে আছি যে।
লেখক
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply